জুলাই সনদের অধ্যায় শেষ পর্যায়ে পৌঁছেছে, যদিও এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিয়ে রাজনৈতিক মহলে উদ্বেগ রয়েছে। এদিকে বিএনপি পুরোদমে নির্বাচনী কার্যক্রমে ডুবে গেছে।
দলের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো জানিয়েছে, দলীয় প্রার্থী বাছাইয়ের প্রক্রিয়া প্রায় শেষ। স্থায়ী কমিটির সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী সভায় ২০০টিরও বেশি আসনের প্রার্থী চূড়ান্ত করে নাম ঘোষণা করা হবে। এই প্রক্রিয়া কয়েক দিনের মধ্যে সম্পন্ন হবে বলে আশা করা হচ্ছে।
প্রার্থী বাছাইয়ে যুক্ত নেতারা জানান, ২০০টিরও বেশি আসনে প্রার্থী প্রাথমিকভাবে চূড়ান্ত করা হয়েছে, বাকি আসনগুলোর কাজ চলছে। এর মধ্যে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনও রয়েছে।
সংশ্লিষ্ট নেতারা বলেন, ৬০ থেকে ৭০টি আসনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্ত করা কঠিন হয়ে পড়েছে দীর্ঘদিনের স্থানীয় রাজনৈতিক সংঘাত ও একই এলাকায় একাধিক শক্তিশালী মনোনয়নপ্রত্যাশীর কারণে। জোট শরিকদের জন্য আসন বরাদ্দেও জটিলতা রয়েছে।
দলীয় সূত্র জানায়, সাংগঠনিক সক্ষমতা, অতীতের আন্দোলনে ভূমিকা এবং একাধিক জরিপের ভিত্তিতে আসনের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। তবে প্রাথমিকভাবে নির্বাচিত প্রার্থী তালিকা চূড়ান্ত নয় এবং পরিবর্তন হতে পারে। মাঠে ভালো পারফর্ম করতে না পারলে কাউকে বাদ দেওয়া হতে পারে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমরা ২০০টিরও বেশি প্রার্থী চূড়ান্ত করেছি। খুব শিগগির স্থায়ী কমিটি তাঁদের নির্বাচনী প্রস্তুতির জন্য সবুজ সংকেত দেবে। কমিটির সভা দু-তিন দিনের মধ্যে হবে।’
১০০ আসনে জটিলতা
বিএনপির প্রার্থী বাছাইয়ে যুক্ত একাধিক নেতা বলেন, জাতীয় সংসদের ৩০০ আসনের মধ্যে প্রায় ১৫০টি আসনে প্রার্থী নির্ধারণ খুব জটিল নয়। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় নেতাদের জন্য প্রায় ৫০টি আসন রয়েছে। তবে প্রায় ১০০টি আসনে স্থানীয় রাজনৈতিক সংঘাত এবং কখনো তিন-চারজন মনোনয়নপ্রত্যাশীর কারণে প্রার্থী নির্ধারণ জটিল হয়ে উঠেছে।
দলীয় সূত্র জানায়, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান সম্ভাব্য প্রার্থীদের জনপ্রিয়তা যাচাইয়ে একাধিক মাঠ জরিপ করেছেন। বিভাগীয় নেতাদের মতামতও নিয়েছেন। এসব যাচাইয়ের ভিত্তিতে প্রায় ১০০টি আসনকে জটিল হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে, যেখানে প্রার্থী চূড়ান্ত করা কঠিন।
এমন জটিল আসনগুলোতে বিভাগীয় দায়িত্বপ্রাপ্ত সিনিয়র নেতারা মনোনয়নপ্রত্যাশীদের ঢাকায় ডেকে একক প্রার্থী নিশ্চিত করার চেষ্টা করছেন। প্রায় প্রতিদিনই সম্ভাব্য প্রার্থীদের ঢাকার গুলশান কার্যালয়ে ডাকা হচ্ছে। তারেক রহমানের নির্দেশ অনুসরণ করে তাঁদের বলা হচ্ছে, দল যাকে মনোনয়ন দেবে, সবাইকে তার পক্ষে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।
এই প্রক্রিয়ায় যুক্ত এক নেতা বলেন, সম্ভাব্য প্রার্থীদের বোঝানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে শেষ পর্যন্ত একজনকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। মনোনয়নপ্রত্যাশী অনেক, দল ক্ষমতায় এলে অন্যদের যথাযথ মূল্যায়ন করা হবে।
শরিকদের জন্য কত আসন
এখনো স্পষ্ট নয় বিএনপির নীতিনির্ধারক নেতাদের কাছে, যুগপৎ আন্দোলনের কিছু শরিক ছাড়া কোন কোন দল ও জোটের সঙ্গে আসন্ন জাতীয় নির্বাচনে তারা চূড়ান্তভাবে জোট করবে। গণতন্ত্র মঞ্চের মতো ছয়-দলীয় জোট, ১২-দলীয় জোট, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), গণফোরাম, জমিয়তে উলামায়ে ইসলামসহ অনেক দল বিএনপির সঙ্গে জোট করে নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী। এদের অনেক দল ও জোট ইতিমধ্যে তাদের প্রার্থী তালিকা বিএনপির কাছে জমা দিয়েছে।
এর বাইরে বিএনপি জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের তরুণ নেতাদের দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), নুরুল হকের গণ অধিকার পরিষদ, মাওলানা মামুনুল হকের বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের সঙ্গেও জোটে আগ্রহী। জোট-সংক্রান্ত নির্বাচনী জোট কতটা হবে বা কোন কোন দল শেষ পর্যন্ত বিএনপির সঙ্গে যুক্ত হবে তা স্পষ্ট না হওয়া পর্যন্ত দলটি পুরোপুরি প্রার্থী ঘোষণা করবে না। নির্বাচনকেন্দ্রিক জোট স্পষ্ট হলে শরিকদের জন্য আসন বরাদ্দ চূড়ান্ত করা হবে।
বিএনপি ক্ষমতায় এলে যুগপৎ আন্দোলনের শরিকদের নিয়ে ‘জাতীয় সরকার’ গঠন করবে বলে ঘোষণা দিয়েছে। এটি মাথায় রেখে শরিকদের কাছ থেকে মনোনয়নপ্রত্যাশীদের তালিকা সংগ্রহ করেছে দলটি। সম্প্রতি যুগপৎ আন্দোলনের দুটি জোট ও পাঁচটি দলের কাছ থেকে মোট ১০৬ জনের তালিকা পেয়েছে বিএনপি। গণতন্ত্র মঞ্চসহ অন্যদের থেকে আরও আসতে পারে। বিএনপি এখন পর্যন্ত জোট শরিকদের জন্য ১৩৮টি আসন বরাদ্দ করেছে বলে জানা গেছে।
বিএনপি নেতাদের প্রাথমিক হিসাব অনুসারে, এনসিপি ও বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস ছাড়া শরিকদের জন্য সর্বোচ্চ ২০টি আসনে মনোনয়ন যোগ্য।
পারিবারিকভাবে একাধিক প্রার্থী না দেওয়ার নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপির শীর্ষ নেতৃত্ব। অতীতে একজন নেতা একাধিক আসনে নির্বাচন করতে পারতেন, কখনো স্বামী-স্ত্রী বা সন্তানদের কোনো কোনো আসনে মনোনয়ন দেওয়া হতো। এবার তা হবে না। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ইতিমধ্যে সিনিয়র নেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলেছেন বলে দলের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।
ফলে মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, সালাহউদ্দিন আহমদ, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ইকবাল হাসান মাহমুদসহ বেশ কয়েকজন নেতার স্ত্রী, সন্তান বা ভাইয়ের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ইচ্ছা থাকলেও তা হবে না। মির্জা আব্বাস ও গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সঙ্গে তারেক রহমান ইতিমধ্যে কথা বলেছেন বলে জানা গেছে।
মির্জা আব্বাস ঢাকা-৮ থেকে এবং তাঁর স্ত্রী আফরোজা আব্বাস ঢাকা-৯ থেকে নির্বাচন করতে চান। গয়েশ্বর চন্দ্র রায় এবং তাঁর পুত্রবধূ নিপুণ রায় চৌধুরী নির্বাচনে অংশ নিতে আগ্রহী, কারণ নিপুণ ঢাকা-৩ (দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ) এলাকায় সক্রিয়।
মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম থাকুরগাঁও-১ থেকে নির্বাচন করবেন। তাঁর ছোট ভাই মির্জা ফয়সাল আমিন জেলা বিএনপির সভাপতি এবং থাকুরগাঁও-২ থেকে নির্বাচনে আগ্রহী।
তারেক রহমান সম্প্রতি গয়েশ্বর চন্দ্র রায় ও নিপুণ রায়কে ডেকে পারিবারিকভাবে একজন প্রার্থী নির্ধারণ করতে বলেছেন। আমানুল্লাহ আমানকেও বলা হয়েছে, তিনি বা তাঁর ছেলে ইরফান ইবনে আমান—যেকোনো একজনকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
নিপুণ রায় প্রথম আলোকে বলেন, পারিবারিকভাবে শুধু একজন প্রার্থী দেওয়া হলে তাঁর শ্বশুর গয়েশ্বর চন্দ্র রায় নির্বাচন করবেন।
জাতীয় সংসদে অন্তত ৫ শতাংশ নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বিএনপি। সে হিসেবে ৩০০ আসনের মধ্যে অন্তত ১৫টি আসনে নারী প্রার্থী দিতে হবে। এ কারণে পারিবারিক নিয়মে ছাড় দেওয়া হতে পারে।